,

সিলেটে শিলাবৃষ্টিতে ম্লান ঈদের আনন্দ :: টিন কিনতেই সর্বস্বান্ত

ডেস্ক রিপোর্ট : ঈদের বাকি আর মাত্র কয়েকটা দিন। দেশের সবাই এখন ব্যস্ত ঈদের কেনাকাটায়। পছন্দসই পোশাকের দোকানগুলোতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। সিলেটেও এখন চলছে জমজমাট কেনাকাটা। তবে এই ঈদের মৌসুমে সিলেটে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন পণ্য পোশাক নয়। শুনতে অবাস্তব লাগলেও সিলেটে এখন সবেচেয়ে বেশি চাহিদা ঢেউটিনের।
পোশাকের চাইতেও এখন ঢেউটিনের দোকানগুলোতে বেশি ভিড়। চাহিদা এতই বেড়েছে যে, প্রয়োজনীয়সংখ্যক ঢেউটিন সরবরাহও করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। অনেকে আবার এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সিলেটে ঈদের কোনাকাটার গতিপথ বদলে যায় গত ৩১ মার্চ রাতে। ওইদিন রাত সোয়া ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তুমুল শিলাবৃষ্টি ঝড় হয় সিলেটে। মাত্র ১৫ মিনিট চলে তাণ্ডব। তাতেই মাটি হয়ে যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার লাখো পরিবারের ঈদ আনন্দ; ভেঙে যায় কয়েক হাজার ঘর। বিশেষত শিলাবৃষ্টিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় এসব ঘরের চালের টিন।
স্থানীয় প্রবীণদের মতে, ৩১ মার্চ বৃষ্টির সঙ্গে পড়া শিলার আকার ছিল অনেক বড়। এত বড় শিলা আগে কখনওই পড়েনি এখানে। ওই রাতের শিলাবৃষ্টির কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। একটি ছবিতে দেখা যায়, বৃষ্টির সঙ্গে পড়া একটি শিলা ওজন মেশিনে পরিমাপ করা হচ্ছে। দেখা যায়, একটি শিলার ওজন দুইশ’ গ্রাম। ওই রাতের শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জেলার বোরো ধান। অনেকের গাড়িরও কাঁচও ভেঙে যায়। তবে সবেচেয় ক্ষতিগ্রস্থ হয় টিনের চাল দেয়া দোকান ও বসতঘরগুলো।
এমনই একজন সিলেট সদর উপজেলার কুমারগাঁও এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়, সঙ্গে শিলা পড়তে থাকে। মনে হচ্ছিল, কেউ ইট দিয়ে চালে ঢিল ছুঁড়ছে। ১৫/২০ মিনিট এমন অবস্থা ছিল, এতেই আমার বাড়ির চালের টিন একেবারে ঝাঁজরা হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘ঘরের সবগুলো টিন পরিবর্তন করতে হচ্ছে। হাজার দশেক টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম ঈদের জন্য, কিন্তু টিন কেনা ও ঘর মেরামতের জন্যে এই টাকা খরচ করে আরও ২৫ হাজার ঋণ করতে হয়েছে। এবার আমাদের ঈদ একেবারে মাটি হয়ে গেল!’
কেবল দেলোয়ার নন, এমন অবস্থা সিলেট ও সুনামগঞ্জের অর্ধলক্ষাধিক পরিবারের। দুই জেলার জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এখনও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চলছে।
তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৩১ মার্চের শিলাবৃষ্টিতে অর্ধ লক্ষাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নগরের সোবহানঘাট এলাকার আল ছালিম ম্যানশনে পাশপাশি কয়েকটি ঢেউটিনের দোকান। বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানগুলোর সামনে পিকআপ, মিনি ট্রাক আর ঠেলা গাড়ির জটলা লেগে আছে। সবগুলো গাড়ি এসেছে ঢেউটিন নেয়ার জন্য। আর দোকানগুলোর সামনে ক্রেতাদের ভিড়। ক্রেতাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বিক্রয়কর্মীরা। কথা বলবারও জো নেই তাদের।
সদর উপজেলার বাঁধাঘাট থেকে এখানে টিন কিনতে এসেছেন আলিম উদ্দিন। পেশায় দিনমজুর আলিম বলেন, ‘শিল পড়ে টিনের অবস্থা আস্ত রাখেনি। এই দুদিন চালে পলিথিন দিয়ে ছিলাম, কিন্তু কালকের বৃষ্টিতে পলিথিনও ছিঁড়ে গেছে। তাই এখন সব জমানো টাকা নিয়ে টিন কিনতে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘ঈদে মেয়েকে নতুন জামা কিনে দেয়ার জন্য কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। সব টাকা দিয়ে এখন টিন কিনতে হচ্ছে। রোজা শুরুর পর থেকেই মেয়ে নতুন জামার জন্য আবদার করছে। এখন তাকে কীভাবে সামলাব জানি না!’
চাহিদা বাড়ায় বিক্রেতারা ঢেউটিনের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ থেকে টিন কিনতে সিলেটের কালীঘাটে এসেছিলেন কাসেম মিয়া। তিনি বলেন, ‘যে টিনের বান আগে ছিল ৬ হাজার টাকা, তা এখন ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ৮ হাজার টাকার টিনের বান ১২ হাজার টাকা হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুর্যোগে পড়া মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বিক্রেতারা অহেতুক দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। শিলাবৃষ্টি আমাদের ক্ষতির মুখে ফেলেছে। আর টিন ব্যবসায়ীরা সর্বশান্ত করে দিচ্ছেন।
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার লালদিঘির পাড়ের টিনের দোকান কাজী অ্যান্ড সন্সের সত্ত্বাাধিকারী কাজী আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘দাম কিছুটা বেড়েছে, তবে তা ২ থেকে তিনশ’ টাকার মতো। আকার ও মান অনুসারে প্রতি বান টিন এখন ৬ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সিলেট জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রায় সাত হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
‘ক্ষয়ক্ষতির তালিকা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ উপজেলায় ৩০ বান্ডিল করে ঢেউটিন, নগদ এক লাখ ৫৬ হাজার টাকা ও চাল প্রেরণ করা হয়েছে। পুরো ক্ষয়ক্ষতির তালিকা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


     এই বিভাগের আরো খবর